করোনা সংকটে বিপর্যস্ত দেশের অর্থনীতি। নানা সংকটে ধুঁকছে ব্যাংক খাত। ঋণের কিস্তির টাকা ফেরত দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থেকে গ্রাহকদের রেহাই দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নতুন ঋণ বিতরণ বেড়েছে অনেক কম হারে। আয়হীন হয়ে পড়ায় টিকে থাকতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে নানা সুবিধা নিয়েছে ব্যাংকগুলো। আবার ১ এপ্রিল থেকে ঋণের বিপরীতে সিঙ্গেল ডিজিট সুদহার বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এর পরও সংকটকালে খাতা-কলমে মুনাফা দেখাচ্ছে ব্যাংকগুলো। গত জুনে পরিচালন মুনাফা কমলেও নিট মুনাফা প্রায় ৪৪ শতাংশ বেড়েছে। আগের বছর লোকসানে থাকা ব্যাংকগুলো করোনা ছাড়ের সুযোগ ব্যবহার করে খাতা-কলমে মুনাফা দেখাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি ব্যাংকগুলোর প্রকৃত চিত্র নয়। এটি হিসাবভিত্তিক। বাস্তবে ব্যাংকগুলো নানা সংকটে জর্জরিত। টিকে থাকার জন্য অনেক ব্যাংককর্মী ছাঁটাই, বেতন কমানো, পদোন্নতি ও ইনক্রিমেন্ট বন্ধ, অন্যান্য ব্যয় কমানো ইত্যাদি পদক্ষেপ নিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, এ বছরের জুনে দেশের ৫৯টি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয়েছে ১০ হাজার ১৯৬ কোটি টাকা। গত বছরের জুনে পরিচালন মুনাফা ছিল ১১ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা। বছরের ব্যবধানে পরিচালন মুনাফা কমেছে ১ হাজার ৩৪১ কোটি টাকা বা ১১ দশমিক ৬২ শতাংশ। তবে পরিচালন মুনাফা কমলেও বেড়েছে নিট মুনাফা। এ বছরের জুনে নিট মুনাফা হয়েছে ২ হাজার ৬২১ কোটি টাকা, আগের বছর যা ছিল ১ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা। নিট মুনাফা বেড়েছে ৮০৭ কোটি টাকা বা ৪৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ। পরিচালন মুনাফা থেকে খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন, কর বাদ দিয়ে নিট মুনাফা বের হয়। এ বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনো গ্রাহক কিস্তির টাকা ফেরত না দিলেও তাকে খেলাপি করা হচ্ছে না। এ সুযোগে গ্রাহকরা টাকা ফেরত দিচ্ছে না। যেহেতু খেলাপি করা হচ্ছে না, ফলে নগদ আদায় না হলেও খাতা-কলমে সুদ আয় দেখাতে পারছে ব্যাংকগুলো। কোনো ঋণ খেলাপি হয়ে গেলে তার বিপরীতে সুদ আয় দেখানো যায় না। যেহেতু খেলাপি করা হচ্ছে না, তার মানে সব ঋণ থেকে সুদ আয় দেখাতে পারছে ব্যাংকগুলো। আবার খেলাপি ঋণ বাড়লে প্রভিশন সংরক্ষণ বাড়াতে হয়। এতে ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফার বড় অংশ খেয়ে ফেলে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে নীতিগত সুবিধা পেয়ে খাতা-কলমে মুনাফা দেখানোর সুযোগ পেয়েছে ব্যাংকগুলো।
নতুন করে খেলাপি না করা, ঋণ খেলাপি করার মেয়াদ বৃদ্ধি, এর ফলে প্রভিশন সংরক্ষণ কম রাখার কারণে সবচেয়ে বেশি সুবিধা হয়েছে সরকারি ব্যাংকগুলোর। গত বছরের জুনে সরকারি খাতের জনতা ব্যাংকের নিট লোকসান ছিল ১ হাজার ৮৮ কোটি টাকা। অথচ ব্যাংকটি এ বছরের জুনে ১৬৪ কোটি টাকা নিট মুনাফা দেখাচ্ছে। অগ্রণী ব্যাংক ১৪১ কোটি টাকা লোকসান থেকে এ বছর নিট মুনাফা করেছে ১৫ কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, গত বছরের জুনের তুলনায় এ বছরের জুনে ব্যাংকের সব ধরনের ব্যবসা কমেছে। গত বছরের জুনে ব্যাংকের ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ; এ বছর তা কমে হয়েছে ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। গত বছরের জুনে ঋণের বিপরীতে গড় সুদ আদায় করেছে ৯ দশমিক ৫৯ শতাংশ হারে। এ বছর করেছে মাত্র ৭ দশমিক ৮২ শতাংশ হারে। আমদানি-রপ্তানি প্রায় বন্ধ থাকায় এ খাত থেকে কমিশন ও অন্য সার্ভিস চার্জ বাবদ আয়ও অনেক কম হয়েছে। এরপর মুনাফা বেড়েছে ব্যাংকগুলোর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, শেয়ারহোল্ডারদের অনেকটা জোর করে মুনাফা দেখাচ্ছে ব্যাংকগুলো। করোনায় মুনাফা বৃদ্ধির বাস্তবসম্মত কোনো কারণ নেই। ব্যাংকগুলো টিকে থাকতে নিজেরাই খরচ কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে। কর্মী ছাঁটাই, বেতন কমানো ও বিভিন্ন ব্যয় যথাসম্ভব কমানোর পদক্ষেপ নিয়েছে অনেক ব্যাংক। সুদ কমাতে আমানতের সুদহার অনেক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঋণের সুদহার কমেছে। এর মধ্যে মুনাফা বৃদ্ধি শুভলক্ষণ নয়। বরং আমানতকারীদের ঠকিয়ে বা অন্য কোনো পদ্ধতিতে শেয়ারহোল্ডারদের খুশি রাখতে এ মুনাফা বেশি দেখানো হচ্ছে। তিনি বলেন, নীতিগত কিছু ছাড় দেওয়ার ব্যাংকগুলোর কিছু ব্যয় কমেছে। ব্যাংকের মুনাফা যদি বাস্তবে বেশি হতো তা হলে কর্মী ছাঁটাই, বেতন কমানোর মতো সিদ্ধান্ত নিতে হতো না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, সরকারি ৬ বাণিজ্যিক ব্যাংকের গত বছর ৯২২ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা হলেও নিট হিসেবে লোকসান হয় ১ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা। এ বছর পরিচালন মুনাফা ১ হাজার ৬৩৬ কোটি টাকা এবং নিট মুনাফা দেখিয়েছে ৮৪ কোটি টাকা। তবে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা ১০ হাজার ৮৮ কোটি টাকা থেকে কমে হয়েছে ৮ হাজার ২৬৯ কোটি টাকা। পরিচালন মুনাফার তুলনায় নিট মুনাফা কমেছে অনেক কম পরিমাণে। নিট মুনাফা ৩ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা থেকে সামান্য কমে হয়েছে ৩ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা।
এদিকে খাতা-কলমে মুনাফা দেখালেও বাস্তবে খরচ কমাতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে ব্যাংকগুলো। খরচ কমানোর অংশ হিসেবে ৮-১০টি ব্যাংককর্মীদের বেতন কমিয়েছে, পদোন্নতি ও ইনক্রিমেন্ট বন্ধ রেখেছে বেশ কয়েকটি ব্যাংক। আবার ৫-৬টি ব্যাংক বিপুল সংখ্যক কর্মী ছাঁটাই করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত জুনে সর্বোচ্চ মুনাফা ৫৩৬ কোটি টাকা মুনাফা করেছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক; গত বছর ছিল ৫৮০ কোটি টাকা। এইচএসবিসির নিট মুনাফা ৩৬৫ কোটি টাকা, যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। সামান্য কমে ইসলামী ব্যাংকের নিট মুনাফা ৩১১ কোটি, ডাচ্-বাংলার ২১৬ কোটি, ইস্টার্নের ১৫৬ কোটি, পূবালীর ১৪৬ কোটি টাকা। মুনাফায় ধস নেমেছে সাউথইস্ট ও ব্র্যাক ব্যাংকের। সাউথইস্ট ব্যাংকের মুনাফা ২৫৬ কোটি থেকে কমে ১৮৮ কোটি এবং ব্র্যাক ব্যাংকের মুনাফা ২৫৬ কোটি থেকে কমে হয়েছে ১৫২ কোটি টাকা।
গত বছর নিট লোকসান করেছে বেসিক ১৭৯ কোটি, বিডিবিএল ২৫ কোটি, কৃষি ব্যাংক ১ হাজার ৩১৫ কোটি, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ৬০৩ কোটি, কমিউনিটি ব্যাংক ১৬ কোটি, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক ২১ কোটি, পদ্মা ৬৮ কোটি, হাবীব ২ কোটি ও ন্যাশনাল ব্যাংক পাকিস্তান ২২ কোটি টাকা।
Leave a Reply